নিজস্ব প্রতিবেদক:
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শিল্পকারখানার গোড়াপত্তন আশির দশকে। বিশ্বমাতানো জামদানি শাড়ির সূতিকাগার এখন ‘রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চল’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে। রাজধানীলাগোয়া ওই অঞ্চলে শিল্পায়নের অন্যতম অনুঘটক শীতলক্ষ্যা নদী। এ কারণে এক যুগ আগে নতুন নতুন শিল্পের পথচলা শুরু হয়েছে। শীতলক্ষ্যাকে ঘিরে গড়ে ওঠা তেমনি একটি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠছে জাহাজ নির্মাণশিল্প।
গ্রামের পথ চলতেই টুকটাক শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম। ডেমরা থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরঘেঁষে উত্তরে কালো অজগরের মতো এঁকেবেঁকে গেছে পিচঢালা সড়ক। সেই রাস্তা ধরে মাত্র তিন কিলোমিটার এগোলেই জাহাজ তৈরির অসংখ্য কারখানার দেখা মিলবে। কোনোটি সবে তৈরি হচ্ছে, কোনোটির নির্মাণকাজ সমাপ্তির পথে। বড় বড় জাহাজ দেখে যে কারও চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। শীতলক্ষ্যাপাড়ের ওই চরটি এখন এলাকাবাসীর কাছে ‘জাহাজের চর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ওই গ্রামের পোশাকি নাম ‘কায়েতপাড়া’, অবস্থান রাজধানীর অদূরে রূপগঞ্জ উপজেলায়।
১০ বছর আগেও বন্যাকবলিত ওই এলাকায় একটি পাখি ডেকে উঠলে তার শব্দ বাতাসে ভেসে দূর-দূরান্তে চলে যেত। বর্ষায় এলাকাবাসীকে নৌকা চড়ে এখানে-ওখানে যেতে হতো। ‘অজপাড়াগাঁও’ বলতে যা বোঝায় তেমনই একটি গ্রাম ছিল এই কায়েতপাড়া। সময়ের ব্যবধানে এখন সেখানেই গড়ে উঠছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প। কয়েক হাজার মানুষের পদচারণায় কায়েতপাড়া এখন এক কর্মমুখর জনপদ। কায়েতপাড়া ইউনিয়নের পূর্বগ্রাম, ভাওয়ালীয়াপাড়া, ডাক্তারখালী, বড়ালু, মাঝিনা, হড়িনা ও ইছাখালীর চরে প্রায় অর্ধশতাধিক জাহাজ তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নের গঙ্গানগর ও দড়িকান্দির চরেও আরও আট-দশটি কারখানা রয়েছে। কায়েতপাড়ার জাহাজ কারখানাগুলোতে আড়াইশ ফুট থেকে শুরু করে শত ফুটের কোস্টার বা মালবাহী জাহাজ, লঞ্চ, সরোঙ্গা, ফেরি, জেটি, পন্টুন, বালুবাহী ট্রলার, বলগেট আর ড্রেজার তৈরি হয়। দিনভর টানা খুট-খাট আর টং-ঢং শব্দে মুখরিত এলাকায় জাহাজ নির্মাণের মহোৎসব চলছে।
রাজধানীর কোলঘেঁষা এই জনপদ একসময় অবহেলিত ছিল। বছরের অর্ধেক সময়ই নিচু এলাকাটি জলমগ্ন থাকত। কৃষিনির্ভর এলাকায় বছরে মাত্র একটি ফসল উৎপাদন হওয়ায় মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাত। এমন এক সময়ে ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুল মালেক ও ফটিক খান নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার সোনাকান্দায় ট্রলার তৈরির কথা জানতে পারেন। সেখানে গিয়ে শীতলক্ষ্যার বুকে জেগে ওঠা সামান্য চরে ট্রলার তৈরি করতে দেখেন তারা। এরপর নিজ গ্রামের চরাঞ্চলে ওই শিল্প চালুর উদ্যোগ নেন। কায়েতপাড়ার প্রায় পতিত চরের জমিকে কাজে লাগাতে তারা একাধিকবার দোহারে যান। জাহাজ মালিকদের সঙ্গেও কথা বলেন। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৫ সালে পূর্বগ্রাম এলাকায় দুটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা চালু হয়। ওই কারখানা দুটি লাভের মুখ দেখার পর একে একে গড়ে উঠেছে অর্ধশত কারখানা। এদিকে, রাজধানীর ডেমরা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নে পূর্বগ্রামের অবস্থান। এখানকার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মেসার্স খান ডকইয়ার্ড। কথা হয় এ কোম্পানির স্বত্বাধিকারী সফিকুল ইসলাম খান রুজেলের সঙ্গে। তিনি জানান, রূপগঞ্জের অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড থেকে বছরে দেড় শতাধিক ছোট-বড় নৌযান তৈরি হচ্ছে। এসবের মধ্যে কার্গো জাহাজ, লঞ্চ, ট্রলার ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তিতে। নৌ বিশেষজ্ঞদের দেওয়া নকশা অনুসরণ করে এখানকার তৈরি বিশ্বমানের জাহাজ বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। তবে স্থানীয় শ্রমিকরা এ কাজে ঝুঁকছেন না বলে জানান তিনি।
তার দাবি, রূপগঞ্জের শিল্পকারখানাগুলোতে স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ করলেও জাহাজ শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে চান না তারা। এসব ডকইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও রংপুরের শ্রমিক। ডকইয়ার্ড মালিকদের দাবি, স্থানীয় শ্রমিকদের এ কাজে সংযুক্ত করতে পারলে অর্ধেক খরচেই শ্রমিক সমস্যার সমাধান হতো। তবে স্থানীয় শ্রমিকরা বলেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে বৈদ্যুতিক তেজস্ট্ক্রিয়তা ও গ্যাসের ব্যবহার থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় এ শিল্পের শ্রমিকদের। এ ছাড়া লোহার ভারী প্লেট স্থানান্তর ও ঝালাই কাজের সময় বৈদ্যুতিক শকের ঝুঁকি থাকে। এ শিল্পে নিরাপত্তা বিধানে ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ কোনো সরঞ্জাম ব্যবহার করে না বললেই চলে। ফলে এ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় স্থানীয়দের রয়েছে অনীহা। ব্যাপক শ্রমিক চাহিদা থাকলেও এ কাজে শ্রমিক পাওয়া নিয়ে হিমশিম খান প্রতিষ্ঠান-মালিকরা। এলাকায় রয়েছে খান ডকইয়ার্ড, ফাহিম ডকইয়ার্ড, শ্যামস, তালহা, আমির, মালেক, ফটিক, মনির, ভাই ভাইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ডকইয়ার্ড শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে শত থেকে শুরু করে আড়াইশ’ ফুট কোস্টার বা মালবাহী জাহাজ, সরোঙ্গা, ফেরি, জেটি, পন্টুন, বালুবাহী ট্রলার, বলগ্যাট, ড্রেজারসহ অত্যাধুনিক নৌযান তৈরি হচ্ছে। গড়ে একটি জাহাজ নির্মাণ করতে দেড় শতাধিক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন। তবে স্থানীয় শ্রমিকদের এ কাজে আগ্রহ না থাকায় মালিক পক্ষ বাড়তি খরচ করে বাঁচিয়ে রাখছে এ শিল্প। সূত্র আরও জানায়, সব মিলিয়ে একটি বড় জাহাজ তৈরিতে ৯ থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ হয়। মালিকদের দাবি, স্থানীয় শ্রমিকরা এ কাজে সম্পৃক্ত হলে এ খরচ প্রায় কোটি টাকা কমে যাবে। জাহাজ মালিক সমিতির নেতা মো: জাহেদ আলী বলেন, সস্তা শ্রমিক, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকায় রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যার উভয় পারে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক জাহাজ তৈরি শিল্প ডকইয়ার্ড। জাহাজ নির্মাণ শিল্প এ অঞ্চলে শিল্পায়নের নতুন দ্বার উম্মোচন করেছে। বহু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। এখানকার কারখানাগুলোয় আড়াইশ ফুটের জাহাজ থেকে শুরু করে ১০০ ফুটের কোস্টার বা মালবাহী জাহাজ, লঞ্চ, সরোঙ্গা, ফেরি, জেটি, পন্টুন, বালুবাহী ট্রলার, বলগেট ও ড্রেজার তৈরি করা হচ্ছে। কিছু প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠলে ও শিল্পের উদ্যোক্তাদের পুঁজিসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হলে ওই শিল্পটি রূপগঞ্জসহ দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’ ‘কাজের তুলনায় বেতন অনেক কম’ হলেও নিজ এলাকায় কাজের সুযোগ পেয়ে খুশি অনেকেই। অন্যদিকে শিল্পের উদ্যোক্তারাও বলছেন, ‘শ্রমিকদের দৈনিক হাজিরা, প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা, বিদ্যুৎ বিল আর জমির ভাড়া গুনতে একটু হেরফের হলেই লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তারপরও সম্ভাবনাময় হওয়ায় এ শিল্প দিন দিন বাড়ছে।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, রূপগঞ্জের সীমানায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান জাহাজ নির্মাণ করছে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও আইনি বিষয় মেনেই তাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা উচিত। সমস্যাগুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে জাহাজ শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এ শিল্পের কারণে এলাকার শত শত বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এ শিল্প কায়েতপাড়া ছাড়িয়ে রূপগঞ্জের অনেক এলাকায় গড়ে উঠেছে।’